খিচুড়ির সাথে প্রথম পরিচয়ের ঘটনা কয়েকদিন ধরে ভেবেও বের করতে পারিনি। যদ্দুর মনে পড়ে- ছোট বেলায় দেখতাম আমাদের এলাকায় আশুরার দিনে গরিব ধনী নির্বিশেষে সবাই খিচুড়ি রান্না করতেন ।একান্ত যাদের সামর্থ ছিলনা তারা ব্যতিক্রম। এছাড়া আমাদের বাড়ির পাশে দুইটি খানকায়(এতিমখানা/পীর বাড়ি বলা যেতে পারে) বার্ষিক মাহফিলের সময়ে অনেক খিচুড়ি রান্না হতো। আমরা অপেক্ষা করতাম আশুরা এবং মাহফিলের দিনগুলোর জন্য। বছরের অন্য সময়ে সাধারণত খিচুড়ি রান্না হতোনা আমাদের ঘরে। কদাচিৎ বৃষ্টির দিনে খিচুড়ি রান্না হতো ।
এক সময় খিচুড়ি বলতে পাতলা খিচুড়িই চিনতাম। গত শতকের শেষের দিকে(সম্ভবত) আটরশি পীরের অনুসারীর সংখ্যা হঠাৎ করেই বেড়ে যায় আমাদের এলাকায়। তারা ঘন(ভূনা) খিচুড়ি রান্নার প্রচলন শুরু করেন। তাদের রান্না করা খিচুড়ি খেতে বেশ লাগত। তবে সেটা দুই একবার খাওয়া হয়েছে কেবল!
২০০৪ সালের শেষের দিকে কর্মসূত্রে বাড়ি ছাড়ি।খিচুড়ি খাওয়ায় সামান্য ভাটা পড়ে। অফিসের সাথেই ডরমেটরিতে থাকি। একসাথে ১০-১২ জন খাই। মাঝে মাঝে এখানেও খিচুড়ি রান্না হতো। এখানে এসে নতুন এক ধরণের খিচুড়ির দেখা পাই। ডাল আর চাল সাথে পানি আর মসলা দিয়ে ভাত খিচুড়ি! ভাত খিচুড়ি বলার কারণ হলো সেগুলো ভাতের মতই থাকত।
হঠাৎ একদিন বিল্ডিংয়ের বসবাসকারীদের মধ্যে বনিবনা না হওয়ায় হাড়ি আলাদা করে ফেলি। নিজেই রান্না শুরু করে দিই। রান্না করা কত ঝামেলার কাজ হাড়ে হাড়ে টের পাই। মাছ কাটা, পেঁয়াজ রসুন কাটা যেমন তেমন সেগুলো পরিমাণমত দেয়াটা এক বেসম্ভবের কাজ। তাই মাঝে মাঝে খিচুড়ি রান্না করতাম। নিজে নিজে এক নতুন খিচুড়ির উদ্ভাবন ঘটিয়ে ফেলি! সবজি খিচুড়ি! তরকারী, চাল, ডাল এক সাথে মিশিয়ে মাঝে মাঝে রান্না করতাম সে খিচুড়ি।
আমার এক স্যার অনেক দূর থেকে আসতেন। বাড়ি থেকে দুপুরের খাবার নিয়ে আসতেন তিনি। একদিন তিনি খাবার আনেননি। তাকে বলি আমার বাসায় খিচুড়ি আছে, চলুন। খিচুড়ি খেয়ে খুবই প্রশংসা করেছিলেন । যখন বলি নিজে রান্না করেছি, তিনি খুবই অবাক হন। আমার রান্না করা খিচুড়ির অনেক প্রশংসা এখনো শুনি।
আমাদের বাড়ির পশ্চিমপাশে একটি করবস্থান আছে। সেখানে ঠান্ডু শা নামের একজনের কবর আছে। তিনি মৃত্যু বরণ করেছেন অনেক বছর পূর্বে। শোনা যায় উনি কিছু কথা বলে গেছেন যা তাঁর মৃত্যুর পর ফলে গেছে! ছোট বেলায় উনাকে নিয়ে মানুষজনের তেমন আগ্রহ দেখিনি কখনো। কয়েক বছর আগে আশপাশের লোকজন উনার কবরটাকে রক্ষণাবেক্ষণ শুরু করেন। বৃহস্পতিবারে(অন্য দিনও হয়তো হয়) রাতের বেলায় উনার কবরের পাশে লোকজন জড়ো হয়ে দোয়া দরূদ পড়েন।কিছু খিচুড়িও রান্না করা হয়। যারা আসেন তারা তৃপ্তি সহকারে খেয়ে যান। প্রচার পেতে থাকে ঠান্ডু শাহের মাজারের(কবরকেই লোকজন বলে) খিচুড়ি খুবই মজা।
কোনো এক ছুটির দিনে বাড়িতে ছিলাম। বিকেলে কেউ একজন খবর দেয় ঠান্ডু শাহের মাজারে খিচুড়ি রান্না হয়েছে! আমিও যাই সেখানে। দেখি এলাহী কান্ড। অনেক লোকজন জড়ো হয়েছে। আমি কিছু সময় দাড়িয়ে দেখি। একজন এক প্লেট খিচুড়ি আমার দিকে এগিয়ে ধরে।আমি খাওয়া শুর করি। আসলেই স্বাদের।
অনেককেই বলতে শুনি বিভিন্ন উৎসবে রান্না করা খিচুড়ি বেশ মজা হয়। আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে যা বুঝতে পেরেছি তা হলো- যে কোনো রান্না স্বাদের হয় যদি সেটিতে পরিমানমতো বা পর্যাপ্ত মসলা দেয়া হয়।কোনো অনুষ্ঠানে যখন কিছু রান্নার আয়োজন হয় সেখানে অনেক মসলার যোগান থাকে, থাকে ঘি সহ আরো অনেক কিছু। আর বাসা/বাড়িতে রান্নার সময়ে ঘরে থাকা সাধারণ মসলা দিয়েই অনেক খাবার রান্না করা হয়। তাই আমরা খাবারের সময় ভালো স্বাদ পাইনা।
আমার বাসায় মাঝে মাঝে খিচুড়ি রান্না হয়। সে রান্নায় অনেক মসলা সহ প্রয়োজনীয় সব উপকরণ পরিমাণমতো দেয়া হয়। সে খিচুড়ি খুবই স্বাদের হয়।
কয়দিন ধরে একটি খবর নিয়ে খুব আলোচনা হচ্ছে যে খিচুড়ি রান্না শিখতে অনেকে বিদেশ যাবেন। আমার মতে চমৎকার স্বাদের খিচুড়ি রান্না করতে পারেন এমন অনেক রাধুনী আছেন আমাদের দেশে।আর অনেক প্রতিষ্ঠান আছে যারা অনেক লোকের খাবার রান্না সহ খাবার বিতরণ করে থাকেন। তাদের কাছ থেকে অভিজ্ঞতা নেয়া যেতে পারে।